প্রসব পরবর্তী মায়ের মনোরোগ
গর্ভধারণ ও সন্তান প্রসব একজন মায়ের জীবনের সবচেয়ে আবেগপ্রবণ ও আনন্দপূর্ণ মুহূর্ত তেমনি অপরদিকে গর্ভকালীন সময়টি যে কোন মায়ের জন্য খুবই সঙ্কটপূর্ণ মুহূর্ত। কারণ জীবন ও মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের মধ্যে মাকে অতিক্রম করতে হয় দিনগুলো। এই সময়ে যে কোন মায়ের যেমন তৈরি হতে পারে নানা রকম শারীরিক সমস্যা তেমনি তৈরি হতে পারে নানা রকম মনোরোগ / মানসিক সমস্যা। এই মনোরোগ কোন কোন ক্ষেত্রে একটি মায়ের মৃত্যুর কারণও হতে পারে। প্রসব পরবর্তী বিষন্নতা তাদের মধ্যে অন্যতম।
মন খারাপের মতো অযৌক্তিক, নেতিবাচক, আবেগ যদি তীব্র আকারে দীর্ঘ সময় ধরে কোন ব্যক্তিকে ঘিরে রেখে তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অথবা যে কোন দুটি ক্ষেত্রে বিচ্যুতি বা বিকার ঘটায় তখন তাকে আমরা বিষন্নতা বলে থাকি।
প্রসব পরবর্তী একটি মায়ের মধ্যে সাধারণত ৩ ধরনের বিষন্নতা পরিলক্ষিত হয় যেমন :
১। নীল মাতৃত্ব / ম্যাটারনিটি ব্লু :
প্রসব পরবর্তী ৩-৫ দিনের মধ্যে বিশেষ করে যারা প্রথম বারের মতো মা হয়েছেন তাদের মধ্যে এই লক্ষণগুলো বেশি পরিলক্ষিত হয়। লক্ষণগুলো হলো।
ক) অস্থিরতা ও অসহিষ্ণুতা।
খ) কান্না কান্না ভাব বা কখনও হাউমাউ করে কান্নাকাটি করা।
গ) এই ভাল এই মন্দ অথবা এই স্বাভাবিক আচরণ একটু পরেই উত্তেজিত আচরণ।
ঘ) মনোযোগের ঘাটতি, কথা ভুলে যাওয়ার প্রবণতা অথবা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা। এই নীলমাতৃত্ব / ম্যাটারনিটি ব্লু এর লক্ষণগুলো ২ সপ্তাহের মধ্যে নিজ থেকেই ভাল হয়ে যায়।
২। প্রসব পরবর্তী বিষন্নতা / পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশন :
সাধারণ এটা প্রাথমিকভাবে নীলমাতৃত্ব/ম্যাটারনিটি ব্লুর মতো মনে হলেও এই রোগের উপসর্গের মাত্রাগুলো তীব্র হয়ে থাকে এবং স্থায়িত্ব ২ সপ্তাহ অথবা ২ সপ্তাহের বেশি হয়ে থাকে। সঠিক সময়ে এই রোগটি চিকিৎসা না করালে ভয়াবহ আকার অর্থাৎ রোগিনী আত্মহত্যাও করতে পারেন। প্রসব পরবর্তী বিষন্নতা/পোস্ট পার্টাম ডিপ্রেশনের উপসর্গগুলো নিম্নক্ত :
ক) দিনের বেশিরভাগ সময় মন খারাপ থাকা।
খ) কোন কাজে আনন্দ খুঁজে না পাওয়া বিশেষ করে আনন্দের কাজে আনন্দ খুঁজে না পাওয়া।
গ) তাৎপর্যপূর্ণভাবে ওজন হ্রাস বা ওজন বৃদ্ধি।
ঘ) ঘুম কমে যাওয়া বা বেশি ঘুমান।
ঙ) উৎকণ্ঠা অথবা কোন কাজে গতি হ্রাস।
চ) নির্জীব অথবা শক্তিক্ষয়।
ছ) নিরর্থক অনুভূতি অথবা অত্যধিক বা অনুপযুক্ত অপরাধ বোধ (যা ভ্রামত্মক হতে পারে)
জ) চিন্তা অথবা মনোনিবেশ করার ক্ষমতা কমে যাওয়া অথবা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগা।
ঝ) বার বার মৃত্যুর চিন্তা মনে আসা, বার বার কোন নির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া আত্মহত্যামূলক অভিপ্রায় ধারণা করা অথবা আত্মহত্যার চেষ্টা করা অথবা আত্মহত্যা করার জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করা।
যদি উপরিউক্ত লক্ষণগুলোর মধ্যে ৫টি অথবা ৫টির বেশি লক্ষণ একটানা ১৫ দিন অথবা তারও বেশিদিন প্রসব পরবর্তী কোন মায়ের মধ্যে বিদ্যমান থাকে তখন তাকে বলায় হয় প্রসব পরবর্তী বিষন্নতা।
৩। মনোরোগের সঙ্গে বিষন্নতা :
প্রসব পরবর্তী বিষন্নতার সঙ্গে যদি ভ্রান্ত ধারণা (ডিলুশান), অমূলক প্রত্যক্ষ (হ্যালুসিনেশন) অর্থাৎ কানে গায়েবি আওয়াজ শোনা অথবা চোখে দেখা ইত্যাদি এবং শিশু হত্যার মতো প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। তখন তাকে বলা হয় মনোরোগের সঙ্গে বিষন্নতা বলে থাকি।
উপরিল্লিখিত প্রধান ৩টি মনোরোগ প্রসব পরবর্তী যে কোন মায়ের মধ্যে পরিলক্ষিত হতে পারে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে মনে করি উপরোক্ত লক্ষণ যদি কোন মায়ের মধ্যে পরিলক্ষিত হয় তাহলে বিলম্ব না করে একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ একটি শিশুর শারীরিক এবং মনের বিকাশের জন্য একটি মায়ের ভূমিকা যেমন অনস্বীকার্য তেমনি একটি মায়ের শারীরিক ও মনের সঠিক যত্নের জন্য তার চারপাশের পরিবার পরিজন এবং আশপাশের মানুষের সঙ্গে সঙ্গে বিশেষ করে স্বামীকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
ডাঃ ফাহমিদা ফেরদৌস
মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসা ভাষাবিদ
সহকারী অধ্যাপক
মনোরোগ বিদ্যা বিভাগ
জেড এইচ সিকদার ওমেন্স মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল।
প্রকাশিত: ২৩ জুলাই ২০১৯; দৈনিক জনকণ্ঠ