শিশুদের এ্যাজমা
সদ্যোজাত থেকে বয়োবৃদ্ধ সবারই হাঁপানি হতে পারে। তবে বাচ্চাদের হাঁপানিতে বেশি ভুগতে দেখা যায়। মোট হাঁপানি রোগীর অর্ধেকের বয়স দশ বছরের মধ্যে। মেয়েদের তুলনায় ছেলেদেরই শিশু বয়সে এই রোগ বেশি হয়।
বাচ্চাদের কেন এত বেশি? হাঁপানি রোগ অনেক কারণে হয়ে থাকে। একই সঙ্গে একাধিক কারণকে এ অসুখের জন্য দায়ী মনে করা হয়। বাচ্চাদের হাঁপানিতে বেশি আক্রান্ত হওয়ার কারণ হিসেবে মনে করা হয় শ্বাসনালীর হাইপার রেসপনসিভনেসকে।
আসলে বড়দের তুলনায় বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটা কম। তাই তাদের বার বার রেসপিরেটরি ট্রাক্টের সংক্রমণের ফলে শ্বাসনালীগুলোতে হাইপার ইরিটেবিনিটি দেখা দেয় অর্থাৎ অতিমাত্রার সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। এই ক্রনিক ইনফ্লামেশনের ফলে বাইরে থেকে কোন কিছু (ঠা-া, মাইট, ধুলো, ফুলের রেণু ইত্যদি) শ্বাসনালীতে ঢুকলেই শুরু হয় সঙ্কোচনের ফলস্বরূপ হাঁপানি। তবে ছোট বাচ্চাদের হাঁপানির লক্ষণ নিয়ে আসনে চিকিৎসককে ভীষণ সজাগ থাকতে হয়। কারণ অনেক সময় লেবুর দানা বা দানার মতো কিছু, বোতাম, পুঁতি ইত্যাদি ফরেন বডি বাবা-মায়ের অজান্তে বাচ্চাদের নাক মুখ দিয়ে ঢুকে শ্বাসনালীতে আটকে থাকতে পারে। এর ফলে সর্দি, কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদিতে বাচ্চাটি ভুগতে পারে। জেনেটিক কারণে কারও কারও বেশি হয়ে থাকে। ঘর-বাড়ির ধুলো-ময়লায় মাইট জিবাণু ফুলের বা ঘাসের পরাগ রেণু, পাখির পালক, জীব-জন্তুর পশম, ছত্রাক, কিছু কিছু খাবার, কিছু কিছু ওষুধ, নানারকম রাসায়নিক পদার্থ ইত্যাদি থেকে এলার্জিজনিত এ্যাজমা হয়ে থাকে।
এ্যাজমাতে কেন এই শ্বাসকষ্ট?
শিশুদের শ্বাসনালীগুলো খুবই ক্ষুদ্র। ২ মি. মি. থেকে ৫ মি. মি. ব্যাসবিশিষ্ট। চারদিকে মাংসপেশি পরিবেষ্টিত। এই ক্ষুদ্র শ্বাসনালীর ভেতর দিয়ে স্বাভাবিক অবস্থায় খুব সহজেই বাতাস আসা-যাওয়া করতে পারে। যদি কখনও এলার্জিক বা উত্তেজক কোন জিনিস শরীরে প্রবেশ করে তখন শ্বাসনালীর মাংস পেশিগুলো সঙ্কুচিত হয়। ফলে শ্বাসনালী সরু হয়ে যায়। তাছাড়া উত্তেজক জিনিসের প্রভাবে শ্বাসনালীর গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হয় আঠালো মিউপাস জাতীয় কফ, আর ইনফেকশনের কারণে শ্বাসনালীর ভেতরের দিককার মিউকাস আবরণী আঠালো কফ উঠিয়ে ফেলার লক্ষ্যে অনবরত কাশি হয়ে থাকে। কখনও কখনও এই শ্বাসনালী এত সরু হয় যে, বাতাস বায়ুথলিতে পৌঁছায় না, তখন শরীরে অক্সিজেনের অভাব হয়। এটা খুবই মারাত্মক অবস্থা। এ অবস্থা বেশিক্ষণ স্থায়ী হলে অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু ঘটতে পারে।
বংশগতভাবে এ্যাজমার ঝুঁকি কতটা?
মাতৃকুলে হাঁপানি থাকলে তিনগুণ বেশি রিস্ক আর পিতৃকুলে হাঁপানি থাকলে অনেকটা কম রিক্স। মায়ের হাঁপানি থাকলে মোটামুটিভাবে বলায় তিন সন্তানের মধ্যে একটির হাঁপানি, একটির আপাত সুস্বাস্থ্য এবং একটির অস্বাভাবিক শ্বাসনালীর সঙ্কোচন থাকতে পারে। শেষেরটির হাঁপানি না হয়ে সর্দি-কাশির প্রবণতা থাকতে পারে।
কিভাবে এই রোগ চিহ্নিত করা যায়?
অনেক বাচ্চাদের প্রায়ই ঠা-া লাগে অর্থাৎ নাক দিয়ে পানি পড়ে, কাশি হয় বিশেষ করে রাতে। যদিও এই লক্ষণগুলোর অধিকাংশ মায়েরা নিউমোনিয়া বলেই চালিয়ে যান। আসলে কিন্তু এ লক্ষণগুলো ছোট বাচ্চাদের এ্যাজমার প্রাথমিক লক্ষণ। পরে অবশ্য বড়দের মতো অন্যান্য লক্ষণগুলোও দেখা দেয়। যেমন-
০ বুকের ভেতর বাঁশির মতো সাঁই সাঁই আওয়াজ
০ শ্বাস নিতে ও ছাড়তে কষ্ট
০ দম খাটো অর্থাৎ ফুসফুস ভরে দম নিতে না পারা
০ ঘন ঘন কাশি
০ বুকে আঁটসাঁট বা দম বন্ধ ভাব
০ রাতে ঘুম থেকে ওঠে বসে থাকা
০ প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা কি?
০ রক্ত পরীক্ষা : বিশেষত রক্তে ইয়োসিনোফিলের মাত্রা বেশি আছে কিনা তা দেখা।
সিরাম আইজিইর মাত্রা : সাধারণত এলার্জি রোগীদের ক্ষেত্রে আইজিইর মাত্রা বেশি থাকে।
০ স্ক্রিন প্রিক টেস্ট : এই পরীক্ষায় রোগীর চামড়ার ওপর বিভিন্ন এলার্জেন দিয়ে পরীক্ষা করা হয় এবং এই পরীক্ষাতে কোন কোন জিনিসে রোগীর এনার্জি আছে তা ধরা পড়ে।
০ প্যাচ টেস্ট : এই পরীক্ষায় রোগীর ত্বকের ওপর করা হয়।
০ বুকের এক্স-রে : হাঁপানি রোগের ক্ষেত্রে চিকিৎসা শুরু করার আগে অবশ্যই বুকের এক্স-রে করে নেয়া দরকার যে অন্য কোন কারণে শ্বাসকষ্ট হচ্ছে কিনা।
০ স্পাইরোমেট্রি বা ফুসফুসের ক্ষমতা দেখা : এই পরীক্ষা করে রোগীর ফুসফুসের অবস্থা সম্পর্কে সঠিক ধারণা করা যায়।
সমন্বিতভাবে এলার্জির চিকিৎসা হলো :
০ এলার্জেন পরিহার : হাঁপানির হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার সবচেয়ে সহজ পন্থা হলো যে জিনিসে এলার্জি তা যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলা। তাই এ্যাজমা রোগীদের প্রথমেই এলার্জি টেস্ট করে জানা দরকার তার কিসে কিসে এলার্জি হয়।
০ ওষুধ প্রয়োগ : নানা ধরনের হাঁপানির ওষুধ আছে। প্রয়োজনমতো ওষুধ ব্যবহার করে রোগী সুস্থ থাকতে পারেন সাধারণত দুই ধরনের ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
ক) শ্বাসনালীর সঙ্কোচন প্রসারিত করতে ওষুধ ব্যবহার করা ব্রঙ্কোডাইলেটর যেমন- সালবিউটামল, থিউফইলন ও ব্যামবুটারন। এ ওষুধগুলো ট্যাবলেট, সিরাপ, ইনজেকশন, ইনহেলার হিসেবে পাওয়া যায়। তবে ছোট বাচ্চাদের প্রেসারের মাধ্যমে ইনহেলার হিসেবে দেয়াই ভাল। কারণ এতে মুখে খাওয়ার চেয়ে অনেক কম ওষুধ লাগে তাই পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও অনেক কম এবং সরাসরি যাওয়াতে অনেক কম সময়ে রোগী সুস্থবোধ করেন। যদিও অনেক অভিভাবক এই ইনহেলার পদ্ধতি পছন্দ করেন না। তাদের ধারণা, ইনহেলার বড় মানুষদের জন্য এবং একবার ইনহেলার দেয়া শুরু করলে সারা জীবন নিতে হবে। এই ধারণা কিন্তু একেবারেই ভুল। অনেক বাচ্চা আছে, যারা রোগের প্রারম্ভিক অবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ইনহেলার নিয়ে সুস্থ আছেন এবং পরবর্তীতে আর ইনহেলার লাগে না। কিন্তু প্রেসারের মাধ্যমে যে কোন বয়সের বাচ্চাদের ইনহেলার দেয়া যায়।
খ) প্রদাহ নিরাময়ের ওষুধ যেমন- কর্টিকোস্টেরয়েড (বেকলোমেথাসন, ট্রাইএ্যামসিনোলোন, ফ্লোটিকাসন) এগুলো ইনহেলার রোটাহেলার, একুহেলার ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়ে থাকে এবং লিউকোট্রাইন নিয়ন্ত্রণ মন্টিলুকাস্ট, জাফিরলুকাস্ট ব্যবহার ব্যবহার করা।
০ এলার্জি ভ্যাকসিন বা ইমুনোথেরাপি : এলার্জি দ্রব্যাদি এড়িয়ে চলা ও ওষুধের পাশাপাশি ভ্যাকসিনও এ্যাজমা রোগীদের সুস্থ থাকার অন্যতম চিকিৎসা পদ্ধতি। এ পদ্ধতি ব্যবহারে কর্টিকোস্টেরয়েডের ব্যবহার অনেক কমে যায়। ফলে কর্টিকোস্টেরয়েডের বহুল পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে রেহাই পাওয়া যায়। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে এ পদ্ধতিতে চিকিৎসা দেয়া হয়ে থাকে। বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এই ভ্যাকসিন পদ্ধতির চিকিৎসাকে এলার্জিজনিত এ্যাজমা রোগের অন্যতম চিকিৎসা বলে অভিহিত করেন।
এটাই এ্যাজমা রোগীদের দীর্ঘমেয়াদী সুস্থ থাকার একমাত্র চিকিৎসা পদ্ধতি।
আগে ধারণা ছিল এ্যাজমা একবার হলে আর সারে না। কিন্তু বর্তমানে চিকিৎসা ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। প্রথম দিকে ধরা পড়েল এলার্জিজনিত এ্যাজমা রোগ একেবারে সারিয়ে তোলা সম্ভব। অবহেলা করলে এবং রোগ অনেকদিন ধরে চলতে থাকলে নিরাময় করা কঠিন হয়ে পড়ে। বর্তমানে এলার্জিজনিত এ্যাজমা রোগের ভ্যাকসিনসহ উন্নত চিকিৎসা আমাদের দেশেই হচ্ছে।
ডা. গোবিন্দ চন্দ্র দাস
দি এলার্জি এ্যান্ড এ্যাজমা সেন্টার
৫৭/১৫ পান্থপথ, ঢাকা
ফোন: ৮১২৯৩৮৩
প্রকাশিত: ৩ ডিসেম্বর ২০১৯; দৈনিক জনকণ্ঠ